বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। সম্প্রতি দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সরকারের ভূমিকা ও রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। খবর দ্য ডিপ্লোম্যাট
নাহিদ ইসলামের রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা হিসেবে। পরে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা হিসেবে উঠে আসেন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমনপীড়নের মুখে পড়েন। অন্তর্বর্তী সরকারে দায়িত্ব পালনের পর তিনি দলীয় রাজনীতিতে ফিরেছেন। প্রচলিত রাজনীতির বিকল্প খুঁজছেন এমন নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার নিয়ে হাজির হয়েছে এই নতুন দল।
দ্য ডিপ্লোম্যাটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ তার নতুন দলের সামনে থাকা চ্যালেঞ্জ, নির্বাচন, বাংলাদেশের কূটনীতির গতিপথ কেমন হওয়া উচিত, কিংস পার্টি প্রসঙ্গ এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনি কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন থেকে সরকারে গিয়েছিলেন, এরপর আবার মাঠের রাজনীতি-আন্দোলনে ফিরে এসেছেন। এই যাত্রায় আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
নাহিদ ইসলাম: সরকারের ভেতরে এবং বাইরে থেকে দেখার অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যখন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন বাংলাদেশের জন্য সময়টা ছিল অত্যন্ত সংকটময়। সেই কঠিন সময়ের মধ্যে সরকারে কাজ করা আমার জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। পরে, সময়ের দাবি মেনে আমি পদত্যাগ করি এবং মূলধারার রাজনীতিতে আসি। এখন আমি এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আমার ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পথ গড়ে তুলতে চাই। আমার কাছে, বিশেষ করে সামনের পথ কঠিন বলে মনে হচ্ছে। একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা আমার জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ, তবে আমি সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: অন্তর্বর্তী সরকারে থাকাকালে আপনি কতটা সংস্কার আনতে পেরেছিলেন?
নাহিদ ইসলাম: আমার স্বল্প সময়ের দায়িত্বকালে আমরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নিয়েছি। ইন্টারনেট অবকাঠামোর স্তরগুলো পুনর্বিন্যাস করেছি, আইসিটি বিভাগের জন্য একটি সংস্কার রোডম্যাপ তৈরি করেছি এবং তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সেন্সরশিপ আইন পর্যালোচনা করেছি। যদিও এই সংস্কারগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রভাব হয়তো এখনই বোঝা যাবে না, তবে আমি বিশ্বাস করি, দীর্ঘ মেয়াদে দেশ এর সুফল পাবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপির পরিকল্পনা কী? এটি কি ডানপন্থী না বামপন্থী দল হবে?
নাহিদ ইসলাম: কোনোটাই নয়। এনসিপি একটি মধ্যমপন্থী রাজনৈতিক দল এবং আমরা এই আদর্শেই অটল থাকব। আমাদের লক্ষ্য হলো, নতুন কণ্ঠস্বরের জন্য একটি ক্ষেত্র তৈরি করা। বিশেষ করে, তরুণ এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য, যারা দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রাজনীতিতে নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরতে পারেননি।
আমরা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ বা ‘দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগোচ্ছি, যার অংশ হিসেবে একটি গণপরিষদ গঠন করতে চাই। এর মাধ্যমে আমরা নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং ক্ষমতার কাঠামো পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করছি। আমরা নতুন নতুন ধারণা (আইডিয়া) অন্বেষণ করছি এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও সুগঠিত করতে মতামত সংগ্রহ করছি।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: অনেকে বলছেন, এনসিপি ‘কিংস পার্টি’ এবং সরকার থেকে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এটা কি সত্যি?
নাহিদ ইসলাম: যদি এনসিপি সত্যিই ‘কিংস পার্টি’ হতো, তাহলে আমি সরকারের পদ থেকে কেন পদত্যাগ করেছি? আমি (সরকারে) থেকে যেতে পারতাম, আমার অবস্থান কাজে লাগিয়ে সরকার থেকেই রাজনীতি করতে পারতাম। আমরা সরকারের কাছ থেকে কোনও বিশেষ সুবিধা পাচ্ছি না। শুধু আন্দোলনে আমাদের ভূমিকার কারণে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে স্বীকৃতি ও অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। এ ছাড়া, অন্তর্বর্তী সরকার কোনও একক দলের সরকার নয়। এখানে নানা মতাদর্শের মানুষ আছেন। ফলে, সরকার সব দলকেই সমানভাবে দেখছে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপি কি জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ? তাদের দাবি অনেকটাই এমন শোনায়। এনসিপি বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানে ভূমিকা রাখবে-এমন আশঙ্কাও আছে!
নাহিদ ইসলাম: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি- আমরা সবাই আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের দাবি জানাই। তাই বলে কি আমরা এক বা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ? একদমই না। যদি তা-ই হতো, তাহলে আমরা জোট গঠন করতাম। এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামী সম্পূর্ণ আলাদা দল। আমাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও ভিন্ন, আমাদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই। জামায়াত আমাদের কাছের দল নয়। আমাদের কিছু দাবি হয়তো মিলে যেতে পারে। যেমন, আমরা সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিই, গণপরিষদ গঠনের কথা বলি, বড় পরিসরে কাঠামোগত পরিবর্তন চাই। কিন্তু এনসিপি মৌলবাদের সঙ্গে একাত্ম-এমন প্রচারের চেষ্টা একটি মিথ্যা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার কৌশলমাত্র। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ কেউ জুলাই বিদ্রোহকে সন্ত্রাসী আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন, যা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনারা সাধারণ নির্বাচন কবে চান?
নাহিদ ইসলাম: আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো- আগের সরকারের অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা, দেশে স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা এবং একটি গণপরিষদ গঠন করা। আমরা সংবিধান ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের পক্ষে, যাতে আর কখনও ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে। তাই নির্বাচন এখনই আমাদের অগ্রাধিকার নয়। আমরা এই মুহূর্তে নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট কোনও সময়সীমা নির্ধারণ করছি না।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: নতুন দল হিসেবে আপনাদের সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন আপনি?
নাহিদ ইসলাম: প্রথমত, বাংলাদেশে বহু পুরোনো ও সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আছে। তাদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আমাদের জন্য কঠিন হবে, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে হাতে সময় কম থাকলে। যদিও নির্বাচন কবে হবে তা নিশ্চিত নয়, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ইঙ্গিত দিয়েছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিকে বা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, তৃণমূল পর্যায়ে আমাদের দলকে পৌঁছে দেওয়াটাও বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রামাঞ্চলের রাজনীতি শহর বা ক্যাম্পাসের রাজনীতির চেয়ে ভিন্ন এবং এর জন্য ভিন্ন কৌশল দরকার। আমরা আগামী মাস থেকে ঢাকার বাইরে প্রচার শুরু করব। এ ছাড়া দেশের বর্তমান সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে আমাদের আন্দোলনেও মনোযোগ দিতে হবে, যাতে জনগণের দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরকারকে চাপ দেওয়া যায়। পাশাপাশি, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনাদের দলের কার্যক্রমে কি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমান সুযোগ পাচ্ছেন?
নাহিদ ইসলাম: হ্যাঁ। অতীতে যা দেখা যেত, তার চেয়ে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও রাজনীতির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তারা গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। আমাদের দল সবার জন্য সমান সুযোগ ও দায়িত্ব নিশ্চিত করে, যাতে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সমৃদ্ধ রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলা যায়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র নিয়ে এনসিপির দৃষ্টিভঙ্গি কী?
নাহিদ ইসলাম: দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের জন্য আমাদের প্রধান দাবি-একটি নতুন সংবিধান, যা প্রণয়নের জন্য একটি গণপরিষদ গঠন করতে হবে। এই সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হতে হবে। আমরা ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থার পক্ষে, যেখানে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সীমাহীন ক্ষমতা বিলোপ করা হবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: বাংলাদেশের কূটনীতির গতিপথ নিয়ে এনসিপির অবস্থান কী? দলটি কি নির্দিষ্ট দেশকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী?
নাহিদ ইসলাম: আমরা চাই, বাংলাদেশ এমন একটি কূটনৈতিক নীতি অনুসরণ করুক, যা ভারসাম্যপূর্ণ ও দেশের জন্য উপকারী এবং কোনও বিদেশি শক্তির প্রভাবমুক্ত। অতীতে আমরা দেখেছি, কিছু রেজিম দিল্লির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল ছিল। তবে আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ভারত কিংবা পাকিস্তান-কোনও দেশকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে দেব না। এনসিপি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশকেন্দ্রিক থাকবে এবং সর্বাগ্রে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দেবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: আপনাদের দল কি আওয়ামী লীগকে রাজনীতি ও আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেবে?
নাহিদ ইসলাম: না! আমরা চাই না, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আগে দলটির ভেতরে যারা অনিয়ম ও অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: এনসিপির রাজনীতির জন্য বর্তমান কোনও দল কি হুমকি হয়ে উঠতে পারে?
নাহিদ ইসলাম: না।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: দল ঘোষণার কয়েক দিনের মধ্যেই সমকামী অধিকারকর্মীকে এনসিপির নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর চাপে করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। অন্তর্ভুক্তির নীতির কথা বলা এনসিপি কীভাবে এই সিদ্ধান্ত নিল?
নাহিদ ইসলাম: আমরা অন্তর্ভুক্তিতে বিশ্বাস করি, তবে আমাদের সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতাকেও গুরুত্ব দিতে হয়। এ কারণেই তাকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে আমাদের দল বৈচিত্র্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে আমাদের অতীত রেকর্ড প্রশংসনীয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট: জুলাই অভ্যুত্থানে নারীরা বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ধারণা করা হয়েছিল, এর ফলে নারীরা আরও নিরাপদ ও স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নারীদের ওপর সহিংসতা ও নীতি পুলিশিংয়ের প্রবণতা বেড়েছে। অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা হিসেবে আপনি কীভাবে এটিকে ব্যাখ্যা করবেন?
নাহিদ ইসলাম: নারীদের ওপর সহিংসতা বেড়ে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। শুধু তা-ই নয়, সমাজে প্রচলিত নানা গভীর বদ্ধমূল ধারণা নারীদের অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রাখছে। দেশে রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে অস্থিরতা বেড়েছে। ৫ আগস্ট পুলিশ বাহিনী ভেঙে পড়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার ফলে এই সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, এখন দেখতে হবে সেগুলো কার্যকর হয় কিনা। ব্যক্তি হিসেবে এবং দল হিসেবে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে।